ডুব
Pedro Novoa
তুমি ডুব দিলে। তলিয়ে পড়ার সাথে সাথে হিরোমি দিদিমার কথা কানে বাজলো, ‘জলের তলার সেই শ্যাওলাগুচ্ছ নিয়ে ফিরিস কিন্ত ।’ হাতে বানানো ডুবুরি-মুখোশের চারপাশে দিদিমার কথাগুলো যেন ভেসে বেড়াতে লাগলো । আলো । কিংবা আঁশ । যেন মাছের শরীর থেকে ঝরে পড়ছে । তুমি আধুনিক চিকিৎসায় ভরসা করে বাজি রেখেছিলে; তাইতো আগেই হেরে গেছো । আয়রন ট্যাবলেট খেয়ে তোমার দাদার অ্যানিমিয়া কমেনি কোন মতেই; হয়তো বা সপ্তাহ কয়েকের জন্য গাল দুটোয় একটু গোলাপী আভা হয়েছিল ।
ততদিনে অবশ্য তোমার ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে – জলে ভেসে থাকা, ক্রমশঃ জলের গভীরে ডুব দেওয়া, আর হরেক রকমের ডাক্তারী পরীক্ষা – যেগুলো বলে দিয়েছে যে তুমি সুস্থ; গভীর জলের জন্য তোমার শরীর তৈরী । সবকিছু নিশ্চিত হয়ে তোমাকে ডুব দিতে হবে – আর মনে রাখতে হবে মিসুকি মায়ের মৃত্যুর কারণ । মিসুকি মা বিজ্ঞানকে অবহেলা করে জনশ্রুতিতে আস্থা রাখতেন । এমনকি বাস্তবের থেকেও তাঁর বেশী বিশ্বাস ছিল জনশ্রুতিতে । দিদিমা এখনও বিশ্বাস করে তাঁর মেয়ে মারা যায় নি, সমুদ্র কেবল তাকে কোলে টেনে নিয়েছে মাত্র । দিদিমার এই ভুল ধারণা কেউ দূর করার চেষ্টাও করে নি । তাইতো মিসুকি মায়ের শ্রাদ্ধের দিন কারোও চোখ থেকে একফোঁটা জলও পড়েনি । কেবল বাবা হিদিও পরে বাথরুমে লুকিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন ।
বাবা অবশ্য চিরকালই নিজের খেয়ালে চলেন । আমাদের পায়ের পাতা যখন শক্ত মাটিতে, বাবা কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ভেসে চলতেন । যেন পৃথিবী বাম দিকে ঘুরছে, আর তিনি ছুটে চলেছেন ঠিক তার উল্টো দিকে ! সবকিছু জেনেবুঝেই তিনি ইয়োচানের ডাক্তারবাবুকে দিয়ে বলালেন সবাইকে নিয়ে বাড়ি বদলের । চোসিকাতে । এই আশায় যে – সেখানকার শুকনো জলহাওয়া তোমার দাদাকে সুস্থ করে তুলবে ।
বাড়ি বদলের কথা জানতে পেরে দিদিমা প্রথমেই বাবাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন । তারপর নিজের বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নিয়ে, “আমি বাড়ী ফিরে যাচ্ছি” – বলে তিনি একদিন তাঁর আশি বছরের শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেলেন সোজা বিমানবন্দরে । ফিরে গেলেন জাপানে । সেখানে গিয়ে এই জেদী মহিলা জীবন কাটালেন একাই – না বিদ্যুৎ , না সুপার মার্কেট, না ক্রেডিট কার্ড । খাবার বলতে – কেবল মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী আর সেই শ্যাওলাগুচ্ছ, যেগুলো সমুদ্র থেকে তিনি নিজেই বেছে নিয়ে আসতেন । এক বছর পর, তাঁর বক্তব্য ছিল একটাই – “এই প্রশান্ত মহাসাগর পুরোটাই তো আমার !”
চোসিকায় কিছুদিন থাকার পরে বোঝা গেলো সেখানকার জলহাওয়া ইয়োচানের স্বাস্থ্যের পক্ষে সুবিধের নয়, বরং ক্ষতিকারক । আবার ফিরে আসা হলো কাল্লাওতে । তোমাকে দিয়েই এই খবর পাঠানো হল হিরোমি দিদিমাকে । কিন্তু তোমাকে একটু ছলের আশ্রয় নিতে হলো । কিছুদিন আগে একটা ভালো চাকরির সুবাদে তোমার বদলি হয়েছে কুসকোতে; কিন্তু তুমি দিদিমাকে মিথ্যা বললে – তুমি লিমাতে থাকো, বাড়ি থেকে ঘণ্টাখানেক দূরের পথ এই যা । তাই, এরপর কোন পারিবারিক অনুষ্ঠান হলেই তোমাকে কোনো না কোনো বাজে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হতো । তোমার সকল আবোলতাবোল অজুহাত দিদিমা মেনে নিতেন কারন তুমিই হলে তাঁর প্রিয় – যদিও তিনি সে কথা সবার সামনে বলতেন না ।
কিন্তু সেদিন টেলিফোন এলো, ইয়োচানের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক – ডাক্তারেরা জবাব দিয়েছেন । একটুকুও না ভেবে তুমি সঙ্গে সঙ্গে লিমা যাওয়ার প্লেন ধরলে । তারপরে দিলে ডুব । তোমার দাদা তখন মৃত্যুর দোরগোড়ায়, বিজ্ঞান এবং আধুনিক চিকিৎসা সব হার মেনেছে, তাই তোমাদের সবার ভরসা দিদিমার সেই শ্যাওলাগুচ্ছর ওপর ।
ইয়োচানের বয়স যখন আট, তখন দিদিমা ডুব দিয়েছিলেন । ষোল বছরের সময় মা মিসুকি । আর ইয়োচানের বয়স এখন চব্বিশ – মৃতসঞ্জীবনী সংগ্রহ করার দায়িত্ব তোমার – তুমিই তো পরবর্তী প্রজন্ম । তোমার জায়গায় তোমার বৌদি যেতে রাজী হয়েছিল, কিন্তু ওর শিরায় শিরায় তো আর ডুবুরির রক্ত বইছে না ! হাজার বছর ধরে তোমাদের পরিবারের মহিলারা সমুদ্রতলে যাত্রা করে এসেছে, ঝিনুক আর মুক্তোর খোঁজে । যতটা মরিয়া হয়ে বৌদি তোমাকে বারবার ফোন করেছিলো দাদার খবর জানাবার জন্য, ঠিক ততোটাই মরিয়া হয়ে বউদি এই মুহূর্তে তোমার কোমরে বাঁধা দড়ি শক্ত করে ধরে আছে । সমুদ্রের নিচে তুমি, আর সমুদ্রের উপর নৌকোতে তোমার বৌদি ভয়ে, কষ্টে—ঘামছে, ¬হাঁপাচ্ছে—তোমার ডুবন্ত শরীর তো খানিকটা তাঁর শরীরও বটে !
তুমি তখন চলেছ অন্য এক জগতে, সমুদ্রগর্ভে – নিকষকালো দুধসাগর ভেদ করে, ডুবসাঁতারের বাতাসবাহী নলটি শিঙার মতন অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে আছে তোমার মুখ থেকে । আর একটা হ্যারিকেনের অস্বস্তিকর আলো, যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকুই । তোমাকে পথ দেখানোর জন্য । তার মৃদু আলোয় – সামনের যাত্রা যেন বাইরের রাত থেকে আরও অন্ধকার আরও গভীর । আর ঠিক এরই মধ্যে, তুমি প্রায় নগ্ন – খোলা বুকে এগিয়ে চললে অনন্তের দিকে – পাখনা ছাড়া, ডুবুরি পোশাক ছাড়া, কেবল ফিনফিনে একটা অন্তর্বাস পরে – ফিউকাস-গোত্রীয় দুর্লভ বাদামী-হলুদ শ্যাওলার খোঁজে । শরীর আর মন তাজা রাখতে ঠিক এই ধরনের শ্যাওলা খেতেন তোমার পূর্বপুরুষ আমাস-মহিলারা – মুক্তোর খোঁজে সমুদ্র গভীরে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে । কাঁচা । এবং চিবিয়ে । নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে । তবে একটাই দুর্ভাগ্য – ফিউকাস-গোত্রীয় এই শ্যাওলা বাসা বানায় প্রায় সমুদ্রতলে; দুরূহ খাড়া পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। তিরিশ মিটার ডুব দিয়ে তুমি বুঝতে পারছ – গভীর সমুদ্রের পাথর কি জটিল আর অমসৃণ !
গুচ্ছ গুচ্ছ ঝিনুকের খোল এবং প্ল্যাঙ্কটন ঝাঁকের মধ্য দিয়ে সাবধানে তুমি পৌঁছে গেছো ফিউকাস শ্যাওলাদলের কাছাকাছি; তাদের ভাসমান ডগাগুলো এখন তোমার আঙ্গুল এবং হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে, মাঝেমাঝে স্পর্শ করছে তোমার খোলা বুক । তুমি টেনে ছিঁড়ে শ্যাওলার গুচ্ছ জোগাড় করতে শুরু করলে, জালি দিয়ে তৈরি পোটলা ভরতি করে তোমার মনে হল – যাক অর্ধেক যুদ্ধ তো জয় হলো . . .
শ্বাস না নিয়ে ঠিক দেড় মিনিট –জলের গভীরে তা অন্তহীন । দু’ একবার মনে হয়েছিল যে তোমার জিভ ফুলছে, জড়িয়ে যাচ্ছে, পিছন দিকে গুটিয়ে যাচ্ছে – ঠিক এই ভাবেই তোমার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল । তিনি গভীর জলের টান অনুমান করতে ভুল করেছিলেন । এই মুহূর্তে একই ভাবে তোমারও মৃত্যু হতে পারে । তাই ফেরার পথে তুমি একটু বেশী সাবধান, দরকারের বেশী নড়াচড়া করছো না – যাতে তোমার শরীরে কারবন-ডাই-অক্সাইড যেন জমে না যায় । তোমার হাত থাইয়ের উপর রেখে, জলের মধ্যে এমনভাবে পা ছুঁড়লে, যাতে অক্ষত শরীরে ভেসে উঠতে পারো – আর ঠিক তখনই তোমার গোড়ালি দুটো জড়িয়ে গেলো দড়ির গিঁটে । তুমি হেরে গেলে . . .
“সমুদ্রকে ভয় পেও না” – হিরোমি দিদিমা বলতেন, “যাকে মনের গভীরে ভালোবাসো, তাঁর জন্য লড়াই করতে আবার ভয় কিসের ?” তোমার হাতেগড়া ডুবুরি-মুখোশের চারিপাশে যেটুকু অবশিষ্ট আলো, এক দল মাছ এসে তাও যেন গিলে ফেললো । উপরে নিশ্চয় বৌদি দড়ি টানাটানি করতে করতে হাঁফিয়ে পরেছে – আর, তারপর দড়ির ছেঁড়া অংশ দেখে খুব ভয় পেয়েছে ।
তোমার ফুসফুসের মধ্যে, শ্বাসপর্দার ওপর অদৃশ্য কেউ যেন একের পর এক ঘুঁষি মেরে চলেছে । কি রকম একটা ঝিমঝিম, একটা ঘুম ঘুম ভাব তোমাকে এই বাস্তব থেকে আরো দূরে নিয়ে যেতে চাইছে । কিন্ত তোমার সেখানে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই, তাই তুমি কোন রকমে দড়ির গিঁঠ ছাড়িয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছো । আর কিছুক্ষণ পরে, হয়তো বা সহজাত প্রবৃত্তিতে, তুমি উপরে উঠে এলে । সেই ফিরে আসার পথ তুমি অতিক্রম করলে ধীরে ধীরে । আর মাত্র পাঁচ মিটার বাকি, নৌকোর তলাটি আস্তে আস্তে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । আর তখনই তুমি দেখতে পেলে, নৌকোর ঠিক পাশেই - জলে ছোপ ছোপ তেলের মত ভাসছে তোমার জীবনের কিছু কিছু টুকরো – খুঁজে পেলে হিদিও বাবার ফ্যাকাশে গাল, ঠিক একই রকম ইয়োচানের গাল, মায়ের প্রথম মুক্তো খুঁজে পাওয়ার হাসি, হিরোমি দিদিমার দৃঢ় কণ্ঠস্বর – সব ভুল ঠিক করার। ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার হাত শক্ত হয়ে এলো, তোমার জিভ যেন একটি আস্ত অজগর, তোমার তালুর কাছে ঘুমাচ্ছে শ্বাসনালী বন্ধ করে । চারপাশের আলো অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, একটু বেশী সাদা, একটু বেশীই ভয়ঙ্কর । আর তুমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে । সেই স্বপ্নের মধ্যে তোমার পা থেকে পাখনা গজাচ্ছে, সেই স্বপ্নের মধ্যে – অক্সিজেন কেবলই অন্ধবিশ্বাস ।
ততদিনে অবশ্য তোমার ট্রেনিং শুরু হয়ে গেছে – জলে ভেসে থাকা, ক্রমশঃ জলের গভীরে ডুব দেওয়া, আর হরেক রকমের ডাক্তারী পরীক্ষা – যেগুলো বলে দিয়েছে যে তুমি সুস্থ; গভীর জলের জন্য তোমার শরীর তৈরী । সবকিছু নিশ্চিত হয়ে তোমাকে ডুব দিতে হবে – আর মনে রাখতে হবে মিসুকি মায়ের মৃত্যুর কারণ । মিসুকি মা বিজ্ঞানকে অবহেলা করে জনশ্রুতিতে আস্থা রাখতেন । এমনকি বাস্তবের থেকেও তাঁর বেশী বিশ্বাস ছিল জনশ্রুতিতে । দিদিমা এখনও বিশ্বাস করে তাঁর মেয়ে মারা যায় নি, সমুদ্র কেবল তাকে কোলে টেনে নিয়েছে মাত্র । দিদিমার এই ভুল ধারণা কেউ দূর করার চেষ্টাও করে নি । তাইতো মিসুকি মায়ের শ্রাদ্ধের দিন কারোও চোখ থেকে একফোঁটা জলও পড়েনি । কেবল বাবা হিদিও পরে বাথরুমে লুকিয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন ।
বাবা অবশ্য চিরকালই নিজের খেয়ালে চলেন । আমাদের পায়ের পাতা যখন শক্ত মাটিতে, বাবা কিন্তু ঠিক সেই সময়ে ভেসে চলতেন । যেন পৃথিবী বাম দিকে ঘুরছে, আর তিনি ছুটে চলেছেন ঠিক তার উল্টো দিকে ! সবকিছু জেনেবুঝেই তিনি ইয়োচানের ডাক্তারবাবুকে দিয়ে বলালেন সবাইকে নিয়ে বাড়ি বদলের । চোসিকাতে । এই আশায় যে – সেখানকার শুকনো জলহাওয়া তোমার দাদাকে সুস্থ করে তুলবে ।
বাড়ি বদলের কথা জানতে পেরে দিদিমা প্রথমেই বাবাকে ত্যাজ্যপুত্র করলেন । তারপর নিজের বাক্সপ্যাটরা গুছিয়ে নিয়ে, “আমি বাড়ী ফিরে যাচ্ছি” – বলে তিনি একদিন তাঁর আশি বছরের শরীরটাকে টেনে নিয়ে গেলেন সোজা বিমানবন্দরে । ফিরে গেলেন জাপানে । সেখানে গিয়ে এই জেদী মহিলা জীবন কাটালেন একাই – না বিদ্যুৎ , না সুপার মার্কেট, না ক্রেডিট কার্ড । খাবার বলতে – কেবল মাছ, সামুদ্রিক প্রাণী আর সেই শ্যাওলাগুচ্ছ, যেগুলো সমুদ্র থেকে তিনি নিজেই বেছে নিয়ে আসতেন । এক বছর পর, তাঁর বক্তব্য ছিল একটাই – “এই প্রশান্ত মহাসাগর পুরোটাই তো আমার !”
চোসিকায় কিছুদিন থাকার পরে বোঝা গেলো সেখানকার জলহাওয়া ইয়োচানের স্বাস্থ্যের পক্ষে সুবিধের নয়, বরং ক্ষতিকারক । আবার ফিরে আসা হলো কাল্লাওতে । তোমাকে দিয়েই এই খবর পাঠানো হল হিরোমি দিদিমাকে । কিন্তু তোমাকে একটু ছলের আশ্রয় নিতে হলো । কিছুদিন আগে একটা ভালো চাকরির সুবাদে তোমার বদলি হয়েছে কুসকোতে; কিন্তু তুমি দিদিমাকে মিথ্যা বললে – তুমি লিমাতে থাকো, বাড়ি থেকে ঘণ্টাখানেক দূরের পথ এই যা । তাই, এরপর কোন পারিবারিক অনুষ্ঠান হলেই তোমাকে কোনো না কোনো বাজে মিথ্যার আশ্রয় নিতে হতো । তোমার সকল আবোলতাবোল অজুহাত দিদিমা মেনে নিতেন কারন তুমিই হলে তাঁর প্রিয় – যদিও তিনি সে কথা সবার সামনে বলতেন না ।
কিন্তু সেদিন টেলিফোন এলো, ইয়োচানের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক – ডাক্তারেরা জবাব দিয়েছেন । একটুকুও না ভেবে তুমি সঙ্গে সঙ্গে লিমা যাওয়ার প্লেন ধরলে । তারপরে দিলে ডুব । তোমার দাদা তখন মৃত্যুর দোরগোড়ায়, বিজ্ঞান এবং আধুনিক চিকিৎসা সব হার মেনেছে, তাই তোমাদের সবার ভরসা দিদিমার সেই শ্যাওলাগুচ্ছর ওপর ।
ইয়োচানের বয়স যখন আট, তখন দিদিমা ডুব দিয়েছিলেন । ষোল বছরের সময় মা মিসুকি । আর ইয়োচানের বয়স এখন চব্বিশ – মৃতসঞ্জীবনী সংগ্রহ করার দায়িত্ব তোমার – তুমিই তো পরবর্তী প্রজন্ম । তোমার জায়গায় তোমার বৌদি যেতে রাজী হয়েছিল, কিন্তু ওর শিরায় শিরায় তো আর ডুবুরির রক্ত বইছে না ! হাজার বছর ধরে তোমাদের পরিবারের মহিলারা সমুদ্রতলে যাত্রা করে এসেছে, ঝিনুক আর মুক্তোর খোঁজে । যতটা মরিয়া হয়ে বৌদি তোমাকে বারবার ফোন করেছিলো দাদার খবর জানাবার জন্য, ঠিক ততোটাই মরিয়া হয়ে বউদি এই মুহূর্তে তোমার কোমরে বাঁধা দড়ি শক্ত করে ধরে আছে । সমুদ্রের নিচে তুমি, আর সমুদ্রের উপর নৌকোতে তোমার বৌদি ভয়ে, কষ্টে—ঘামছে, ¬হাঁপাচ্ছে—তোমার ডুবন্ত শরীর তো খানিকটা তাঁর শরীরও বটে !
তুমি তখন চলেছ অন্য এক জগতে, সমুদ্রগর্ভে – নিকষকালো দুধসাগর ভেদ করে, ডুবসাঁতারের বাতাসবাহী নলটি শিঙার মতন অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে আছে তোমার মুখ থেকে । আর একটা হ্যারিকেনের অস্বস্তিকর আলো, যতটুকু দরকার, ঠিক ততটুকুই । তোমাকে পথ দেখানোর জন্য । তার মৃদু আলোয় – সামনের যাত্রা যেন বাইরের রাত থেকে আরও অন্ধকার আরও গভীর । আর ঠিক এরই মধ্যে, তুমি প্রায় নগ্ন – খোলা বুকে এগিয়ে চললে অনন্তের দিকে – পাখনা ছাড়া, ডুবুরি পোশাক ছাড়া, কেবল ফিনফিনে একটা অন্তর্বাস পরে – ফিউকাস-গোত্রীয় দুর্লভ বাদামী-হলুদ শ্যাওলার খোঁজে । শরীর আর মন তাজা রাখতে ঠিক এই ধরনের শ্যাওলা খেতেন তোমার পূর্বপুরুষ আমাস-মহিলারা – মুক্তোর খোঁজে সমুদ্র গভীরে যাবার ঠিক আগের মুহূর্তে । কাঁচা । এবং চিবিয়ে । নিজেদেরকে প্রস্তুত করতে । তবে একটাই দুর্ভাগ্য – ফিউকাস-গোত্রীয় এই শ্যাওলা বাসা বানায় প্রায় সমুদ্রতলে; দুরূহ খাড়া পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। তিরিশ মিটার ডুব দিয়ে তুমি বুঝতে পারছ – গভীর সমুদ্রের পাথর কি জটিল আর অমসৃণ !
গুচ্ছ গুচ্ছ ঝিনুকের খোল এবং প্ল্যাঙ্কটন ঝাঁকের মধ্য দিয়ে সাবধানে তুমি পৌঁছে গেছো ফিউকাস শ্যাওলাদলের কাছাকাছি; তাদের ভাসমান ডগাগুলো এখন তোমার আঙ্গুল এবং হাত ছুঁয়ে যাচ্ছে, মাঝেমাঝে স্পর্শ করছে তোমার খোলা বুক । তুমি টেনে ছিঁড়ে শ্যাওলার গুচ্ছ জোগাড় করতে শুরু করলে, জালি দিয়ে তৈরি পোটলা ভরতি করে তোমার মনে হল – যাক অর্ধেক যুদ্ধ তো জয় হলো . . .
শ্বাস না নিয়ে ঠিক দেড় মিনিট –জলের গভীরে তা অন্তহীন । দু’ একবার মনে হয়েছিল যে তোমার জিভ ফুলছে, জড়িয়ে যাচ্ছে, পিছন দিকে গুটিয়ে যাচ্ছে – ঠিক এই ভাবেই তোমার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল । তিনি গভীর জলের টান অনুমান করতে ভুল করেছিলেন । এই মুহূর্তে একই ভাবে তোমারও মৃত্যু হতে পারে । তাই ফেরার পথে তুমি একটু বেশী সাবধান, দরকারের বেশী নড়াচড়া করছো না – যাতে তোমার শরীরে কারবন-ডাই-অক্সাইড যেন জমে না যায় । তোমার হাত থাইয়ের উপর রেখে, জলের মধ্যে এমনভাবে পা ছুঁড়লে, যাতে অক্ষত শরীরে ভেসে উঠতে পারো – আর ঠিক তখনই তোমার গোড়ালি দুটো জড়িয়ে গেলো দড়ির গিঁটে । তুমি হেরে গেলে . . .
“সমুদ্রকে ভয় পেও না” – হিরোমি দিদিমা বলতেন, “যাকে মনের গভীরে ভালোবাসো, তাঁর জন্য লড়াই করতে আবার ভয় কিসের ?” তোমার হাতেগড়া ডুবুরি-মুখোশের চারিপাশে যেটুকু অবশিষ্ট আলো, এক দল মাছ এসে তাও যেন গিলে ফেললো । উপরে নিশ্চয় বৌদি দড়ি টানাটানি করতে করতে হাঁফিয়ে পরেছে – আর, তারপর দড়ির ছেঁড়া অংশ দেখে খুব ভয় পেয়েছে ।
তোমার ফুসফুসের মধ্যে, শ্বাসপর্দার ওপর অদৃশ্য কেউ যেন একের পর এক ঘুঁষি মেরে চলেছে । কি রকম একটা ঝিমঝিম, একটা ঘুম ঘুম ভাব তোমাকে এই বাস্তব থেকে আরো দূরে নিয়ে যেতে চাইছে । কিন্ত তোমার সেখানে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই নেই, তাই তুমি কোন রকমে দড়ির গিঁঠ ছাড়িয়ে উপরে উঠে আসার চেষ্টা করছো । আর কিছুক্ষণ পরে, হয়তো বা সহজাত প্রবৃত্তিতে, তুমি উপরে উঠে এলে । সেই ফিরে আসার পথ তুমি অতিক্রম করলে ধীরে ধীরে । আর মাত্র পাঁচ মিটার বাকি, নৌকোর তলাটি আস্তে আস্তে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে । আর তখনই তুমি দেখতে পেলে, নৌকোর ঠিক পাশেই - জলে ছোপ ছোপ তেলের মত ভাসছে তোমার জীবনের কিছু কিছু টুকরো – খুঁজে পেলে হিদিও বাবার ফ্যাকাশে গাল, ঠিক একই রকম ইয়োচানের গাল, মায়ের প্রথম মুক্তো খুঁজে পাওয়ার হাসি, হিরোমি দিদিমার দৃঢ় কণ্ঠস্বর – সব ভুল ঠিক করার। ঠিক সেই মুহূর্তে তোমার হাত শক্ত হয়ে এলো, তোমার জিভ যেন একটি আস্ত অজগর, তোমার তালুর কাছে ঘুমাচ্ছে শ্বাসনালী বন্ধ করে । চারপাশের আলো অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে, একটু বেশী সাদা, একটু বেশীই ভয়ঙ্কর । আর তুমি স্বপ্ন দেখতে শুরু করলে । সেই স্বপ্নের মধ্যে তোমার পা থেকে পাখনা গজাচ্ছে, সেই স্বপ্নের মধ্যে – অক্সিজেন কেবলই অন্ধবিশ্বাস ।